যেসকল সেবার বিপরীতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপন করা বাধ্যতামূলক

যেসকল সেবার বিপরীতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপন করা বাধ্যতামূলক

সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি এবং সার্বিক করজাল সম্প্রসারণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বা পিএসআর উপস্থাপন নিশ্চিত করার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। এজন্য এনবিআর কর্তৃক ৪৩টি সেবার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যে ৪৫ সেবার বিপরীতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বা পিএসআর জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক

এনবিআর নিম্নোক্ত ৪৫ টি সেবার বিপরীতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বা পিএসআর জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। এই সেবাগুলো প্রাপ্তি বা গ্রহণের ক্ষেত্রে করদাতাদের অবশ্যই রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে হবে।

১. ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে

২. স্পন্সর্ড শেয়ারহোল্ডার বা কোনো কোম্পানির পরিচালক পদে পদায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে

৩. আমদানি/রপ্তানি নিবন্ধন সনদ প্রাপ্তি বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে

৪. সিটিকর্পোরেশন  বা পৌরসভার এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি বা নবায়নের ক্ষেত্রে

৫. যেকোনো সমবায় সমিতির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে

৬. সাধারণ বিমার সার্ভেয়ার হিসেবে লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি বা নবায়নের ক্ষেত্রে

৭. কোনো সিটিকর্পোরেশন , পৌরসভা, জেলা সদর, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের পৌরসভার অভ্যন্তরে অবস্থিত জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে। জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্টের দলিল মূল্য ১০ লক্ষ টাকার বেশি হলে, সেক্ষেত্রে বাসিন্দা বা মালিক কর্তৃক দলিল হস্তান্তর, বায়নানামা অথবা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অথবা জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয়ের রেজিস্ট্রি গ্রহণের ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। 

৮. ক্রেডিট কার্ড প্রাপ্তি বা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে

৯. চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি বা সার্ভেয়ার বা অনুরূপ অন্য কোনো পেশায় পেশাগত সংস্থার সদস্যপদ অর্জন বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে

১০. মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৪ (১৯৭৪ সনের এলআইআই) এর অধীনে নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্তি ও বহাল রাখার ক্ষেত্রে

১১. কোনো বাণিজ্য বা পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ লাভ বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে 

১২. ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র সনদ, বিএসটিআই লাইসেন্স এবং ছাড়পত্র প্রাপ্তি বা নবায়নের ক্ষেত্রে 

১৩. কোনো এলাকায় গ্যাসের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ গ্রহণ বা অব্যাহত রাখা এবং সিটিকর্পোরেশন  এলাকায় গ্যাসের আবাসিক সংযোগ গ্রহণ বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে

১৪. লঞ্চ, স্টিমার, ফিশিং ট্রলার, কার্গো, কোস্টার, ডাম্ব বার্জ ইত্যাদিসহ যেকোনো নৌযানের জরিপ সনদ সংগ্রহ বা অব্যাহত রাখা, ভাড়ায় চলাচলের ক্ষেত্রে

১৫. পরিস্থিতি অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জেলা বা পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ইট উৎপাদনের অনুমতি বা অনুমতি নবায়নের ক্ষেত্রে 

১৬. যেকোনো সিটিকর্পোরেশন , জেলা সদর বা পৌরসভায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রম বা জাতীয় পাঠ্যক্রমের ইংরেজি ভার্সন অনুযায়ী শিক্ষা প্রদানকারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিশুদের বা নির্ভরশীল ব্যক্তির ভর্তির অনুমতি অর্জনের ক্ষেত্রে

১৭. সিটিকর্পোরেশন  বা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহণ বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে। 

১৮. কোম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ প্রাপ্তি বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে

১৯. অস্ত্রের লাইসেন্স প্রাপ্তি বা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে

২০. আমদানির উদ্দেশ্যে ঋণপত্র (এলসি) প্রণয়নের ক্ষেত্রে

২১. ৫ লাখ টাকার বেশি পোস্টাল সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে 

২২. ১০ লাখ টাকার বেশি ক্রেডিট ব্যালেন্সসহ যেকোনো প্রকার ব্যাংক হিসাব খোলা ও চালু রাখা

২৩. ৫ লাখ টাকার অধিক সঞ্চয়পত্র (সঞ্চয়পত্র) ক্রয়ের ক্ষেত্রে

২৪. উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটিকর্পোরেশন  বা জাতীয় সংসদের যেকোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে

২৫. যেকোনো যৌথ অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে মোটরযান, স্থান, আবাসন, বা অন্যান্য কোনো সম্পদ প্রদানের ক্ষেত্রে

২৬. ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক কার্যক্রমে অথবা উৎপাদন কার্যক্রমে কোনো তত্ত্বাবধায়ক অবস্থানে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে “বেতন” হিসেবে যেকোনো পরিশোধিত আয় গ্রহণের ক্ষেত্রে

২৭. সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে 

২৮. মোবাইল ব্যাংকিং বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর বা মোবাইল ফোন অ্যাকাউন্ট রিচার্জের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো কমিশন, ফি বা অন্য কোনো চার্জ গ্রহণের ক্ষেত্রে

২৯. কোনো কোম্পানির কাছ থেকে কোনো পরামর্শ বা পরামর্শ সেবা, ক্যাটারিং সার্ভিস, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস, জনবল সরবরাহ বা নিরাপত্তা সেবা প্রদান বাবদ কোনো প্রকার অর্থ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে

৩০. মাসিক ১৬,০০০ টাকার অধিক পরিশোধের অর্থ এমপিওভুক্ত সরকারের কাছ থেকে গ্রহণ করতে হবে এমন বিষয়ের ক্ষেত্রে 

৩১. বিমা কোম্পানির এজেন্সি সার্টিফিকেট নিবন্ধন বা নবায়নের ক্ষেত্রে

৩২. দুই ও তিন চাকার যানবাহন ব্যতীত যেকোনো প্রকার মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নের ক্ষেত্রে

৩৩. এনজিও বিষয়ক ব্যুরো বা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির লাইসেন্সধারী ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাকে বৈদেশিক অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে

৩৪. যেকোনো ডিজিটাল প্লাটফর্ম কর্তৃক বাংলাদেশের ভোক্তাদের কাছে যেকোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে

৩৫. কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এবং সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬০ এর অধীন নিবন্ধিত ক্লাবের সদস্যপদের জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে

৩৬. পণ্য সরবরাহ, চুক্তি সম্পাদন বা সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে কোনো বাসিন্দা কর্তৃক দরপত্র দলিল দাখিলের ক্ষেত্রে

৩৭. কোনো কোম্পানি বা ফার্ম হতে যেকোনো ধরনের পণ্য বা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন ইন্টেরিয়র ফার্ম

৩৮. বাংলাদেশে আমদানি বা রপ্তানির জন্য বিল অব এন্ট্রি দাখিল করার ক্ষেত্রে

৩৯. কোনো সিটিকর্পোরেশন  বা পৌরসভায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) এবং রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) বা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভের উদ্দেশ্যে ইমারত নির্মাণের পরিকল্পনা দাখিল করার ক্ষেত্রে

৪০. দলিল লেখক, ডাকটিকিট ও কোর্ট ফি বিক্রেতাদের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে

৪১. সমবায়, ট্রাস্ট, এনজিও ইত্যাদির ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে 

৪২. সিটিকর্পোরেশন  এলাকায় বাসা ভাড়া ও ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে

৪৩. নির্দিষ্ট সংস্থাগুলোর জন্য পণ্য সরবরাহ এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে

৪৪. হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, মোটেল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহের লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নকালে;

৪৫. সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থিত কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল বা সমজাতীয় কোনো সেবা গ্রহণকালে।

উপরোক্ত ৪৫ টি বিশেষ সেবার বিপরীতে করদাতাকে অবশ্যই রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। অন্যথায়, এই সেবাগুলো প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। 

রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বা পিএসআর জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা

রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়ার প্রধান কারণগুলো হল:

১। আইনি বাধ্যবাধকতা
বাংলাদেশের আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট আয়সীমার উপরে আয়ের ব্যক্তিদের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা না দিলে আইনত জরিমানা বা শাস্তি হতে পারে।

২। আর্থিক স্বচ্ছতা
রিটার্ন দাখিল একজন নাগরিককে তার আয়ের সঠিক হিসাব এবং পরিশোধিত কর সরকারের কাছে উপস্থাপন নিশ্চিত করে। এটি করদাতার আয়ের বৈধ উৎস নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।

৩। অর্থনৈতিক উন্নয়ন
সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য কর আদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিয়ে করদাতারা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখেন।

৪। পরিকল্পনা এবং সেবা প্রাপ্তি
সরকার নাগরিকদের কর প্রদানের সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে বার্ষিক উন্নয়নমূলক কাজ বা বাজেট পরিকল্পনা করে থাকে। করদাতার রিটার্ন দাখিলের তথ্য এই প্রক্রিয়াকে সহজতর করে।

৫। ব্যক্তিগত সুবিধা লাভ
রিটার্ন দাখিল করলে ব্যবসায়িক চুক্তি, ব্যাংক ঋণ, ভিসা আবেদন ইত্যাদিতে করদাতার আয়ের প্রমাণপত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মূলত, রাষ্ট্রের আর্থিক প্রবাহ সুনিশ্চিত করে উন্নয়ন পরিকল্পনায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণপত্র উপস্থাপনে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে থাকে।

উপসংহার

বাংলাদেশের কর কর্তৃপক্ষ হিসেবে এনবিআর করব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রসারণের জন্য এবং রাষ্ট্রের সকল উন্নয়নকাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র উপস্থাপনে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে থাকে। একজন সুনাগরিক হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের আয়ের বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ে কর প্রদান করা এবং আয়কর রিটার্ন দাখিল করা ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রমাণ সংরক্ষণ করা। 

 

Share this Post

Comments (0)

Leave a comment

BD Taxation
Visitor Counter
Today's Hits 5054
Yesterday's Hits 15365
Total Hits 948847